জাতীয় নির্বাচনে ছাত্রসমাজের করণীয়

16. November 2018 রাজনীতি 0
জাতীয় নির্বাচনে ছাত্রসমাজের করণীয়

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোল বেজে উঠেছে। ভোটারদের দরজায় কড়া নাড়ছে সেই নির্বাচন। সকলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে জাতীয় নির্বাচন। চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে অফিস আদালত, পাড়া-মহল্লা সবখানেই সর্বাধিক আলোচিত বিষয় একাদশ জাতীয় নির্বাচন। এবারের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা বা কৌতূহল একটু বেশি হওয়ার মুল কারণ নির্বাচন কেমন হবে তা নিয়ে। ২০১৪ সালের মতো একতরফা, ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন বিনাভোটের হাস্যকর নির্বাচন? নাকি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। ভোটারদের মনে এসব জিজ্ঞাসার পাশাপাশি রয়েছে নানা শঙ্কা ও সংশয়। আর নির্বাচনই আদৌ হবে কী হবে না তা নিয়ে চলছে নানামুখী বিচার-বিশ্লেষণ। এসব সংশয়ের যৌক্তিক কারণ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। সারাদেশে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে চলছে অভিযান, করা হচ্ছে পাইকারি গণগ্রেফতার। আর তালিকা করে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের নামে দেয়া হচ্ছে গায়েবি মামলা। এসব মামলায় সর্বোচ্চ নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মী-সমর্থক, দলীয় ভোটার কাউকেই রেহাই দেয়া হচ্ছে না। এমনকি মৃতব্যক্তি, নাবালক, হজে কিংবা দেশের বাইরে থাকা নেতাকর্মীরাও রেহাই পায়নি এসব গায়েবি মামলা থেকে।

দেশের নির্বাচন-পূর্ববর্তী যখন এমন নাজুক পরিস্থিতি তখন বিরোধী শক্তিকে পুলিশের মামলা হামলা আর হয়রানির মধ্যে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ট্রেনে যাত্রা শুরু করেছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচনী প্রচারাভিযান পরিচালনার জন্য গত ৮ সেপ্টেম্বর রেলপথ যোগে উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়েছে। পরবর্তীতে তারা নদীপথ ও সড়কপথেও সারাদেশে প্রচারাভিযান চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সময়ের প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট হবে আসলে জাতির ভাগ্যে কী রয়েছে।

জাতি হিসেবে আমাদের রয়েছে গৌরবময় সোনালি ইতিহাস। বহুকষ্ট আর ত্যাগে সোনালি ইতিহাস রচিত হয়েছে। জাতির ইতিহাসে এমন কোনো অর্জন নেই যে অর্জনের পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছাত্রসমাজ ছিল না। ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর থেকে এখন পর্যন্ত এদেশে সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে যতগুলো আন্দোলন-সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে প্রায় সবগুলোতেই অগ্রসেনানীর ভূমিকা পালন করেছে এদেশের ছাত্রসমাজ। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ২০১৩ এ রাজবন্দী মুক্তি আন্দোলন, ২০১৪ এ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২০১৮-এর কোটাসংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামেই সামনের সারিতে ছিল এদেশের ছাত্রসমাজ।

আগামী জাতীয় নির্বাচন এদেশের ছাত্রসমাজের সামনে সুন্দর দেশ বিনির্মাণের এক সুবর্ণ সুযোগ। কারণ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়। সাথে সাথে পরিবর্তন হয় জনগণের ভাগ্যেরও। এদেশের মানুষের ভাগ্য এমনি করে বহুবার বদলেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে ৭ই মার্চ। এ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২৯৩ আসনে ভূমিধস বিজয় লাভ করে। আওয়ামী লীগের ১১ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। মোট ১৪টি দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। মজার বিষয় হলো এ নির্বাচনে ‘বাংলা ছাত্রইউনিয়ন’ নামে একটি ছাত্রসংগঠনের একজন প্রতিনিধি দলীয়ভাবে(ছাত্রসংগঠনের নামেই) ‘দোয়াত ও কলম’ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেয়। দেশের প্রথম এ নির্বাচনে কোন বিরোধী দল ছিল না। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ২০৭টি আসন লাভ করে। এ নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ এ উন্নীত করা হয়। উল্লেখ্য, প্রথম নির্বাচনে এ সংখ্যা ছিল ১৫। এ নির্বাচনে মোট ২৯টি দল অংশ নেয়। এ নির্বাচনেও ১১ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। প্রথম নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় লাভ করা আওয়ামী লীগ মাত্র ৩৯টি আসন লাভ করে বিরোধী দল হয়। এ নির্বাচনে আইডিএল নামে জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৬টি আসন লাভ করে।

তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৮৬ সালের ৭ মে। এ নির্বাচনে জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ১৫৩ আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। এ নির্বাচনে ২৮টি দল অংশগ্রহণ করে। ৭৬টি আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের দায়িত্বে উপনিত হয়। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এ নির্বাচনে সরাসরি অংশ নিয়ে ১০টি আসন লাভ করে। এ নির্বাচনে কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পারেনি। এ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ দেশের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল একতরফা নির্বাচন। এ নির্বাচন বিএনপি আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করে। এ নির্বাচনে মাত্র ৯টি দল অংশ নেয়। এরশাদের জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসন লাভ করে। জাতীয় পার্টির ১৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। আ স ম আবদুর রব এরশাদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বিরোধী জোট ১৯টি আসন লাভ করে। সংরক্ষিত ৩০টি মহিলা আসনসংক্রান্ত আইনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় চতুর্থ জাতীয় সংসদে কোনো সংরক্ষিত নারী আসন ছিল না।

স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী সম্মিলিত আন্দোলনের ফলে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে মোট ৭৫টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। বিএনপি ১৪০, আওয়ামী লীগ ৮৮, জাতীয় পার্টি ৩৫, জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসন লাভ করে। জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দল হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। এ নির্বাচনে সংরক্ষিত ৩০ আসন আবার চালু হয়। ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। অধিকাংশ প্রধান রাজনৈতিক দলের বর্জন সত্ত্বেও বিএনপি এসময় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। নামসর্বস্ব ৪২টি দল এ নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপি ২৭৮ আসনে জয়ী হয়। ফ্রিডম পার্টি মাত্র একটি আসন পেয়ে প্রধান বিরোধী দল হয়। এ নির্বাচনে বিএনপির ৪৯ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

এ নির্বাচনের পর জোরদার হয় কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন। আওয়ামী লীগ, জামায়াতসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এ দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে যুগপথ আন্দোলনে সোচ্চার হয়। আওয়ামী লীগ ও জামায়াত এ সময় রাজপথে যৌথভাবে আন্দোলন করে। কেয়ারটেকার বা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা জাতির সামনে উপস্থাপন করেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম। জামায়াতের দেয়া ফর্মুলা তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তীব্র আন্দোলনের মুখে বিএনপি পদত্যাগ করে। পরবর্তীতে ১২ জুন ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মোট ৮১টি দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ ১৪৬, বিএনপি ১১৬, জাতীয় পার্টি ৩২ ও জামায়াতে ইসলামী এ নির্বাচনে ৩টি আসনে বিজয়ী হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন প্রথম এ নির্বাচনে বিচারপতি হাবিবুর রহমান ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী আর খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেত্রী হন। ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর দেশের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্বিতীয় নির্বাচন। বিচারপতি লতিফুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ছিলেন। এ নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩, আওয়ামী লীগ ৬১, জামায়াতে ইসলামী ১৭, জাতীয় পার্টি ১৪টি আসন লাভ করে। এ নির্বাচনে মোট ৫৫টি দল অংশ নেয়। খালেদা জিয়া তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনা বিরোধী দলের প্রধান হন। সংরক্ষিত মহিলা আসন সংক্রান্ত আইনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সংসদে কোনো সংরক্ষিত আসন ছিল না।

২০০৬ সালের শেষের দিকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্দিষ্ট করা থাকলেও ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী লগি- বৈঠার তাণ্ডবের পর নির্বাচন বানচালের লক্ষ্যে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার পহেলা নভেম্বর দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে। ২০০৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর তা প্রত্যাহার করে ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। এ সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ছিলেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। আর সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল মইনউদ্দিন আহমেদ। কথিত আছে, আওয়ামী লীগ আর মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের যোগসাজশে অনুষ্ঠিত হওয়া এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০ আসনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এরশাদের জাতীয় পার্টির ২৭টি আসন আর বিএনপির ২৯টি ও জামায়াতে ইসলামী ২টি আসন লাভ করে। এ নির্বাচনে ২৮টি দল অংশগ্রহণ করে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী আর বেগম খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় প্রধান হন।

সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। বিএনপি-জামায়াতসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে এ নির্বাচন বর্জন করে। এ নির্বাচনে মাত্র ১২টি দল অংশগ্রহণ করে। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দলের অংশগ্রহণের নির্বাচন। স্বৈরাচারী এরশাদের সময় চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে ৯টি দল অংশ নিয়েছিল। দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের মতে, এ নির্বাচনে মাত্র ৫ শতাংশ ভোট পড়ে। ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, যা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকেই দেশ-বিদেশে মারাত্মক প্রশ্নবিদ্ধ করে। কারণ সরকার গঠন করতে প্রয়োজন ১৫১ আসন। সেখানে ১৫৪ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মোট ২৩৪ আসনে বিজয়ী হয়। শেখ হাসিনা তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। জাতীয় পার্টি ৩৪টি আসনের বিজয়ী হয়। সরকারের মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণ করেও এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হয়। অবশ্য শেখ হাসিনা কৌশলে’ এরশাদকে বাদ দিয়ে তার স্ত্রী রওশন এরশাদকে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা বানায়। একে গৃহপালিত বিরোধী দল বলে আখ্যায়িত করেন বিশ্লেষকদের অনেকেই।

বাংলাদেশের এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নানা উত্থান-পতন আর ঘটনাপ্রবাহের ছিল নির্বাচনগুলো। নির্বাচন কারো কাছে ক্ষমতায় আরোহণের আর কারো কাছে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার সিঁড়ি। রাজনৈতিক দলগুলো দেশের স্বার্থে রাজনীতির পরিবর্তে নিজেকে, নিজেদের চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করার রাজনীতিতে ব্যস্ত। এদেশের নির্বাচন হলো ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি। দেশের রাজনীতি বা নির্বাচনের গতি প্রকৃতি বা পরিস্থিতি যা চাক্ষুষ দেখছি, আর যা ইতিহাস পড়ে জেনেছি তা এমনই ধারণা দেয়। রাজনীতিতে আদর্শের উপস্থিতি খুবই সামান্য। একটি দেশ কখনো আদর্শহীন রাজনীতি দিয়ে কাঙক্ষিত মনজিলে পৌঁছতে পারে না। সম্পদ লুণ্ঠন, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার যদি রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে থাকে তাহলে তা আমাদেরকে সাময়িক সমৃদ্ধি দিতে পারে কিন্তু তা কখনো টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথ দেখাতে পারে না। এদেশের ছাত্রসমাজকেই আজ সেই পথ দেখাতে হবে। ছাত্রসমাজকে দুর্নীতি, দুঃশাসনের পথ চিরতরে বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে। আজকে যেসকল ছাত্রনেতা চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজির সাথে জড়িত, সে ছাত্রনেতা যখন জাতীয় নেতা হবে তখন লুটপাট, দুর্নীতি ও ঘুষ থেকে বিরত থাকবে কিভাবে? ছাত্রজীবনে যে ছাত্রনেতা ধর্ষণ, ইভটিজিং, অশ্লীলতায় যুক্ত সে যখন জাতীয় নেতা হবে তখন কিভাবে এসব বন্ধ করবে? যে ছাত্র বর্তমানে মাদক গ্রহণ করে, ইয়াবা ব্যবসা করে, ফুলের টবে গাঁজার চাষ করে সেই ছাত্রনেতা এমপি মন্ত্রী হলে ইয়াবা সম্রাট হবে, মাদক চোরাকারবারি হবে এটাই তো স্বাভাবিক। গণতন্ত্রের অন্যতম মূলকথা পরমতসহিষ্ণুতা। যে ছাত্রনেতা ক্যাম্পাসে বিরোধী মতকে সহ্য করতে পারে না, গুলি, লাঠি ও হাতুড়ি পেটা করে, এ ছাত্রনেতা ভবিষ্যতে যদি মূল রাজনৈতিক দলের প্রধান বা সাধারণ সম্পাদক হন তাহলে ছাত্রজীবনের চর্চাটাই তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে করবেন। মামলা হামলা দিয়ে, পুলিশকে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে দমানোর সব চেষ্টাই তিনি করবেন। এ অবস্থা থেকে দেশের রাজনীতিকে মুক্ত করে আনতে ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে। ছাত্রসমাজের সামনে জাতীয় নির্বাচন সে সুযোগেরই অংশ।

ছাত্রসমাজের সকলেই ভোটার নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে একেকজন ছাত্র আগামীর একেকজন রাষ্ট্রনায়ক। আগামীর দেশটা কেমন চাই? উত্তর এদেশের তরুণরা যেমন চায়। এমন তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নের আগামী ছাত্রসমাজকেই বিনির্মাণ করতে হবে। ছাত্রসমাজকে নিজেদের ঘরে-বাইরে, ক্যাম্পাসে, নিজ গ্রামে, এলাকায়, পাড়া-মহল্লায়, প্রতিবেশী, আত্মীয় সবার মাঝেই সেই স্বপ্নের সোনালি দেশ তৈরির আকাঙ্ক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। সবার মাঝে নৈতিক চেতনাবোধকে জাগাতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, জুলুমের বিরুদ্ধে, গুম খুনের বিরুদ্ধে ব্যালটকে মজলুমের হাতিয়ারে পরিণত করার শ্লোগান তুলতে হবে। দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার আর পেশিশক্তির জোরে যারা নিরীহ সাধারণ জনগণের ওপর জুলুম নির্যাতনের ছড়ি ঘোরাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করাতে ছাত্রসমাজকে প্রয়াস চালাতে হবে। যারা প্রকাশ্য দিবালোকে লগি বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে লাশের ওপর নৃত্য করে, যারা প্রকাশ্য রাজপথে বিশ্বজিৎ দাসকে পিটিয়ে হত্যা করে জয় বাংলা শ্লোগানে উল্লাস করে। তাদের বিরুদ্ধে জাতিকে সচেতন করার দায়িত্ব ছাত্রসমাজকেই নিতে হবে।

যারা নিজেদের স্বার্থে বৈষম্য টিকিয়ে রেখে চেতনার কথা বলে ছাত্রসমাজকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, যারা এদেশের ৯৮% মানুষের যৌক্তিক দাবি কোটা সংস্কারের দাবি দমাতে দলীয় ছাত্রসংগঠনকে লেলিয়ে দেয়, পুলিশ-র‌্যাব দিয়ে ক্যাম্পাসের মতো শিক্ষাভূমিকে রণক্ষেত্রে পরিণত করে, ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সাথে কথা দিয়ে কথা না রেখে উল্টো প্রতারণা করে, নির্মম নির্যাতন চালায়। যারা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবিতে-নামা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর হামলা গুলি চালিয়ে জিঘাংসা চরিতার্থ করে তাদের বিরুদ্ধে আগামী নির্বাচনে বলিষ্ঠকণ্ঠে ছাত্রসমাজকেই সোচ্চার হতে হবে।

ছাত্রসমাজ নিশ্চয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকরের কথা ভুলে যায়নি। যিনি ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হয়েছিলেন। ছাত্রসমাজ নিশ্চয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটাসংস্কার আন্দোলনের নেতা নুর, মশিউরের ওপর ছাত্রলীগের নৃশংস হামলা, ছাত্রী নেত্রীকে লাঞ্ছনার দৃশ্য সহজেই স্মৃতি থেকে মুছে ফেলেনি। রাশেদের পেছনে ডিবি পুলিশের ধাওয়া দেয়া ভিডিও লাইভে রাশেদের বাঁচাও বাঁচাও আর্তচিৎকার ভুলে যায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরে এক নেতাকে ছাত্রলীগ কর্তৃক প্রকাশ্যে পা কেটে নেয়ার রক্তাক্ত ছবির দৃশ্য এখনো ছাত্রসমাজের দৃশ্যপট থেকে মুছে যায়নি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটাসংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহবায়ক তরিকুলের ওপর ছাত্রলীগ কর্তৃক হাতুড়িপেটা করে পঙ্গু করে দেয়ার বিভীষিকা এখনো ভুলে যায়নি। এ সবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই হবে আগামী নির্বাচনে ছাত্রসমাজের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ভোট ডাকাতি করে যেন কোনোভাবেই তারা আবার ছাত্রসমাজের ওপর জনগণের ওপর এমন নির্মমতা না চালাতে পারে সে জন্য প্রতিটি ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে হবে। ভোট ডাকাতরা এদেশের মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে আবার তাদেরই ওপর ছড়ি ঘোরাবে সেই সুযোগ সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে।

অন্যায় জুলুম-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ে ছাত্রসমাজও ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করবে। ছাত্রসমাজ কখনো ব্যর্থ হয় না, পরাজিত হয় না। ছাত্রসমাজ নিজেদের অধিকার আদায় ছাড়া কখনো ঘরে ফেরে না। ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকায় যদি মায়ের ভাষার অধিকার আদায় হতে পারে, ছাত্রসমাজের সহযোগিতায় যদি জাতি তার স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, ছাত্রসমাজের তীব্র আন্দোলনে যদি স্বৈরাচারের সিংহাসন ভেঙে চুরমার হতে পারে, ছাত্রসমাজের বুক পেতে দেয়া আন্দোলনে যদি কোটাসংস্কার দাবি ফ্যাসিবাদি সরকারও মানতে বাধ্য হতে পারে- তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকায় নব্য স্বৈরাচারের ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনও হতে পারে। ছাত্রসমাজই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা আর প্রত্যাশার প্রতীক। জুলুমশাহির কবল থেকে মুক্তি এবং জাতির প্রত্যাশা পূরণে ছাত্রসমাজ আগামী একাদশ নির্বাচনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে ইনশাআল্লাহ। পরিশেষে বলবো- “দুর্নীতি আর দুঃশাসন, রুখবে এবার জনগণ”!

লেখকঃ কেন্দ্রীয় সভাপতি, BANGLADESH ISLAMI CHHATRASHIBIR.