শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বনাম শেখ হাসিনার রাজনীতি

শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বনাম শেখ হাসিনার রাজনীতি

২৫ মে রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় সফরে জাপানের রাজধানী টোকিওতে পৌঁছলে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা জাপানিরা প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে এলে প্রধানমন্ত্রী সেসব বন্ধুর হাতে শেখ মুজিবুর রহমানের ইংরেজি ভার্সন অসমাপ্ত আত্মজীবনী (Unfinished Memory of Sheikh Mujib) বইটি উপহার দেন। ১২ মার্চ রাত ৮টার বিটিভির সংবাদের প্রথম খবরটি ছিল উপমহাদেশের বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ, অস্কারবিজয়ী শিল্পী, এ. আর রহমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। সাক্ষাতের সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, শেখ রেহানার ছেলে ববি সিদ্দিকী এবং শেখ রেহানাসহ পরিবার ও কর্মকর্তা পর্যায়ের আরো অনেকে। আনন্দঘন পরিবেশে সাক্ষাৎ শেষে প্রধানমন্ত্রী এ. আর রহমানকে একটি বই উপহার দেন। বিটিভির নিউজে ধারণকৃত দৃশ্যে দেখলাম বইটি প্রধানমন্ত্রীর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। এ. আর রহমান ১৩ মার্চ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিতব্য টি-২০ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্টেজ শোতে পারফরম করার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেই সুবাদেই এই সৌজন্য সাক্ষাৎ। গত সপ্তাহের কোন একদিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ বেতারের ১০৬.০ এফএম ব্যান্ডে অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটির কিছু অংশ পড়ে শোনানো হয়। পরে বেতারের ঘোষকের মাধ্যমেই জানলাম নিয়মিতই এটি পাঠ করে প্রচার করা হয়।
নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বিদেশী মেহমানকে কোনো বই উপহার দেন তখন সেই বইটির গুরুত্ব অনেক বেশি। এই কৌতূহলে জেলখানায় বন্দী থাকা অবস্থায় কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-১ এর লাইব্রেরি থেকে বইটি সংগ্রহ করে পড়তে শুরু করি। বইটি যতই পড়ি ততই আমি শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সাথে তারই কন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতির তুলনা করতে গিয়ে বিস্মিত হই। অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি মূলত ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটক থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান লেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। ২০০৪ সালে সেসব লেখার চারটি পাণ্ডুলিপি শেখ হাসিনার হস্তগত হলে ২০১২ সালের জুন মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের গ্রন্থস্বত্বে বইটি প্রথম প্রকাশ করা হয়। আত্মজীবনীতে শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে বসেই অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি জেল-জুলুম, নিগ্রহ-নিপীড়ন, গ্রেফতার, রি-অ্যারেস্ট, দমন-নিপীড়ন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গুলি করে হত্যাসহ জুলুমের কিছু চিত্র তুলে ধরেছেন। তার লেখনীতে শেখ মুজিবুর রহমান নির্যাতনের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তারই গুণধর কন্যা শেখ হাসিনা চার যুগেরও বেশি সময় পরে তারই দেশের মানুষের ওপর সেই ধরনের জেল-জুলুম, নির্যাতন কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই সীমাকেও মারাত্মকভাবে অতিক্রম করে চলেছেন। বইটি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দিতে ব্যাক পেজে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা একটি সংক্ষিপ্ত কোটেশন তুলে ধরা হয়েছে যা মূল বইয়ের ২০৯ পৃষ্ঠায় বিবৃত আছে যাতে তিনি লিখেছেন, “একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা, আব্বা’ ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। এক সময় কামাল হাসিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি’ আমি আর রেণু দু’জনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, আমি তো তোমারও আব্বা। কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়। আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দী রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।”
ব্যাক পেজের এই লেখাটি পড়ে যে কারোই চোখে পানি চলে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আজ বাংলাদেশ এক বৃহৎ কারাগার। শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের নিরপরাধ হাজারো নাগরিক বিনা বিচারে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে কারাগারে বন্দী। এসব বন্দীর মাঝে শেখ কামালের মতো বয়সী শত শত শিশুর পিতারাও আজ কারাগারে। বন্দীর পরিবার যখন শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত তার বাবার এই লেখনী পড়বে তখন নিশ্চয়ই ধিক্কার, ক্ষোভ আর ক্রোধ ছাড়া কিইবা জানাবে। বইয়ের ভেতরে ১৮৭ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারায় শেখ মুজিবুর রহমান তাকে পুনরায় গ্রেফতার/রি-অ্যারেস্ট সংক্রান্ত একটি বিষয়ে লিখেন, “সতের-আঠার মাস পরে ছেড়ে দিয়েও আবার গ্রেফতার করার কী কারণ থাকতে পারে? পরদিন লোক ফিরে এসে বলল, রাতভর সকলে জেগেছিল বাড়িতে, আমি যে কোন সময় পৌঁছাতে পারি ভেবে, মা অনেক কেঁদেছিল খবর পেলাম। আমার মনটাও খারাপ হলো। আমার মা, আব্বা ও ভাই বোন এবং ছেলেমেয়েদের এ দুঃখ না দিলেই পারত।” রি-অ্যারেস্ট করার মাধ্যমে যে দুঃখ শেখ মুজিবুর রহমানের মাকে কাঁদিয়েছিল আজ প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা কি দেশের শত শত বন্দীর মায়েদের সেই কান্নার প্রতিধ্বনি শুনতে পান না? না হলে ৪৭ বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এখনো কেন হবে? এখনো কেন মায়েরা তাদের সন্তানের রি-অ্যারেস্টের নিউজ শুনে কেঁদে বুক ভাসাবে। কেন কোর্ট কাচারি দৌড়িয়ে অনেক কষ্টে জামিন লাভের পরও প্রিয় পরিজনের মুক্তির প্রত্যাশায় থাকা পরিবারের সদস্যরা রি-অ্যারেস্ট শুনে আঁতকে উঠবে, হার্ট ফেল করবে। কোন কোন ক্ষেত্রে এখন শুধু ১-২ বার না ৪-৫ বারও রি-অ্যারেস্ট করে পুনরায় বন্দী করে রাখা হচ্ছে। ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের লিয়াকত আলী খানকে রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় গুলি করে হত্যা করা হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গুলি করে হত্যার প্রসঙ্গ টেনে ১৯৫ পৃষ্ঠার তৃতীয় প্যারায় শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ করেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুলি করে হত্যা করা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর। আমরা যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তারা এই জঘন্য কাজকে ঘৃণা করি। ১৯৫১ সালে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গুলি করে হত্যা করাকে শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে জঘন্য কাজ বলে অভিহিত করেছেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শেখ মুজিবের দৃষ্টিতে যেটা চরম ঘৃণার কাজ, তারই কন্যা শেখ হাসিনা যিনি গণতন্ত্রের মানসকন্যার উপাধিও ধারণ করেন, তার শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে সেই খুন, গুমেরই মহোৎসব। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ও পরে শুধুমাত্র এক মাসেই ৩ শতাধিক বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী হয়তো খুন নয়তো গুম হয়েছেন। আর সব ক্ষেত্রেই অভিযোগের তীর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে। ঢাকায় ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের দুই নেতা ওয়ালিউল্লাহ ও আল মোকাদ্দাসসহ শত শত গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তির মধ্যে এরা উল্লেখযোগ্য কয়েকজন মাত্র।
পুলিশের গ্রেফতারের পর যখন সীতাকুন্ডে ইউনিয়ন জামায়াত নেতা আমিনুল ইসলাম, মেহেরপুর জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি তারেক সাইফুল্লাহ, লক্ষ্মীপুরে জামায়াতের নায়েবে আমীর ফয়েজ আহমেদ, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরে কথিত হামলা মামলার প্রধান ৩ আসামির গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। যখন যৌথ বাহিনীর অভিযানের নামে সাতক্ষীরায় প্রকাশ্য দিবালোকে জামায়াতের ৫ নেতাকর্মীকে গুলি করে হত্যা করাসহ প্রায় অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে খুন করে ক্রসফায়ারের নাটক সাজানো হয়, যখন দেশের নালা-নর্দমা, খাল-বিলে খণ্ড-বিখণ্ড লাশের সন্ধান মিলে তখন ভাবতে কষ্ট হয় এই কি গণতান্ত্রিক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, যেখানে রাস্তায় জীবনের নিরাপত্তা নেই, এমনকি নিজ ঘরের বেড রুমের নিরাপত্তা দিতেও অপারগতা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ মুজিবের লেখনীর দৃষ্টিতে যেটি জঘন্য এবং ঘৃণ্য কাজ, এখন তারই কন্যা শেখ হাসিনার দম নিপীড়নের হাতিয়ার সেটি। অবশ্য দমন নিপীড়ন করেও যে শেষ রক্ষা হয় না এ ব্যাপারে ১১০ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারায় উল্লেখ করেছেন তিনি, যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেন- ‘মুসলিম লীগ নেতারা বুঝতে পারছিলেন না যে পন্থা তারা অবলম্বন করেছিলেন সেই পন্থাই তাদের ওপর একদিন ফিরে আসতে বাধ্য। ওনারা ভেবেছিলেন গুণ্ডা দিয়ে মারপিট করেই জনমত দাবাতে পারবেন। এ পন্থা যে কোনদিন সফল হয় নাই আর হতে পারে না এ শিক্ষা তারা ইতিহাস পড়ে শিখতে চেষ্টা করেন নাই।’ শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি যা লিখে গেছেন তার সাথে তার জীবনের সত্যিকার বাস্তবতা কতটুকু তা ইতিহাসই নির্ধারণ করবে। কারণ বাকশাল গঠন আর রক্ষীবাহিনী গঠন করে অগণিত মানুষকে হত্যা করার ইতিহাস লুকানোর সুযোগ নেই। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় তার কন্যা যে উদ্দেশ্য নিয়ে পিতার আত্মজীবনী বই (Unfinished Memory of Sheikh Mujib) বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনে প্রকাশ এবং প্রচার করছেন তার সাথে শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনার দিকগুলো মেলাতে গিয়ে পাঠক যদি সত্যিই দুঃখ বা আহতবোধ করেন তাহলে পিতার আত্মজীবনী প্রচারের সার্থকতা কোথায়। শেখ মুজিবুর রহমানের লেখনীর দৃষ্টিতে গুম, খুন, হত্যা, দমন নিপীড়ন, জেল-জুলুম দিয়ে যেভাবে জনমত দাবিয়ে রাখা যায় না ইতিহাস থেকে সেই শিক্ষা কি তার কন্যা শেখ হাসিনা গ্রহণ করবেন? নাকি তার পিতার বক্তব্য অনুযায়ী সেই মানুষদের কাতারেই তিনি থাকবেন যারা স্বার্থের কারণে অন্ধ হয়ে যায়!


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *