শিকল পরা হাতের পরশ

আমি একজন প্রতীকী নুমায়ের বলছি। আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ নুমায়ের। আমাকে হয়তো আপনারা অনেকে চিনবেন। কারণ আমার জন্মের খবরটি সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। আমি যেদিন ভূমিষ্ঠ হই সেদিন আমার জন্মদাতা বাবা ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বন্দী ছিলেন জালিমের বন্দিশালায়। ওহ বাবা শব্দটি শুনলে আমার শরীরে এক রোমাঞ্চ শিহরিত হয়! মনের ভেতর কেন জানি এক হাহাকারের প্রতিধ্বনি বেজে ওঠে। আচ্ছা বলুনতো সন্তান জন্মগ্রহণ করলে সবচেয়ে বেশি আনন্দ কে পায়? সন্তানকে জড়িয়ে কোলে নিয়ে পরম স্নেহের আদর কে বুলিয়ে দেয়? সেতো জন্মদাতা বাবাই। কিন্তু আমার কি দুর্ভাগ্য দেখুন, আমার জন্মের পর বাবার কোলে আমি উঠতে পারিনি। পৃথিবীর সকল বাবার মতো সদ্যজাত সন্তানকে কোলে নিয়ে উচ্ছ্বাস আর আনন্দ উদযাপনের সেই মুহূর্তটি আমার বাবার ভাগ্যে জোটেনি। শিশু জন্মের পর তার কণ্ঠ থেকে কান্নার ধ্বনি উচ্চারিত হলেও সবার আনন্দে তা ছাপিয়ে যায়। আমার ক্ষেত্রে চিত্রটা ছিল ভিন্ন। আমার গৃহে আনন্দের পরিবর্তে আমার কান্নার প্রতিধ্বনি যেন সবার কান্নাকে একাকার করেছিল। কারণ সবাই তখন আফসোস করে বলাবলি করছিল ইস জন্মদাতা বাবা উপস্থিত থাকলে কতই না আনন্দ হতো!
জানি না জন্মের কত ঘন্টা বা কত দিন পর বাবা দুনিয়াতে আমার আগমনের সংবাদ শুনেছিলেন। অন্ধকার লোহার শিকলের ভেতর থেকে আমার জন্মের সংবাদ যখন বাবাকে দেয়া হয়েছিল, জানি না তখন তার অবস্থা কী হয়েছিল। তখন নিশ্চয়ই আনন্দ ছাপিয়ে বাবার বুকে এক কঠিন শূন্যতা বিরাজ করেছিল। আমাকে কোলে নিয়ে আদর করতে না পারার শূন্যতা বাবাকে কতদিন কষ্টে রেখেছিল আমি জানি না। বাবার সেই সময়ের রাতগুলো কেমন কেটেছে জানি না। বিছানায় ছটফট করতে করতে হয়তো রাতের অন্ধকার কেটে ভোরের আলো উদ্ভাসিত হয়ে যেত। নির্ঘুম রজনী কাটতো আমার মুখাবয়বের চিত্র অঙ্কন করে। আর আমাকে কোলে নিয়ে আদর করতে না পারায় বারবার দীর্ঘশ্বাস বাবার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করতো। বাবা হয়তো কাউকে তা বুঝতে দিতেন না। বাবা অনেক বড় মানুষ বলে, আমাকে আদর করতে না পারার শূন্যতাকে জীবনের কঠিন সংগ্রামের সাথে হয়তো মিলিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু সদ্যজাত সন্তানের প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ না করতে পারার কষ্ট একজন বাবা কতক্ষণ চাপা দিয়ে রাখতে পারেন বলুনতো।
বাবা হয়তো কষ্ট লুকিয়ে রেখে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সাথে হাসিমুখে আনন্দের সংবাদকে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমাকে কোলে নিয়ে মা যখন আদর করছিলেন তখন মায়ের চোখের কোণে আনন্দ অশ্রুর পরিবর্তে যন্ত্রণা আর বিষাদের অশ্রু ঠাঁই নিয়েছিল। আমার মায়ের আদর আর চোখের জল সেদিন একাকার হয়ে গিয়েছিল। মা ভেবেছিলেন জন্মের পর বাবাই আমার কানে আল্লাহু আকবার তাকবির ধ্বনি দিয়ে আজান দেবেন। কিন্তু সেই পরম সৌভাগ্য বাবার হয়নি। আমারও তা ভাগ্যে জোটেনি। মা হয়তো আবেগকে সংবরণ করতে বৃথা চেষ্টা করেন। আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখে নিজেকে আড়াল করতে জানেন। কিন্তু বাবার অনুপস্থিতির কথা চিন্তা করলে চোখের অশ্রুকে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারেন না।so1
আমি সদ্যজাত শিশু। কত জনের আদর আমি পেয়েছি, কত জনের কোলে আমি চড়েছি তার কোনো হিসাব নেই। সবাই আমাকে কোলে নিয়ে আদর ¯েœহ আর মমতা দিয়ে তৃপ্তি দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বলুনতো বাবার আদরে যে তৃপ্তি তা কি অন্য কারো আদরে পূর্ণতা পায়? বাবার কোলে চড়ে যে প্রশান্তির পরশে নিজেকে জড়ানো যায় তাকি আর কারো কোলে চড়ে পাওয়া যায়? আপনি যদি বাবা হয়ে থাকেন কিংবা কোনো বাবার সন্তান হয়ে থাকেন তাহলে একটু ভেবে দেখুনতো।

আমার জন্মের সাত দিন পর আমি আমার জন্মদাতা বাবার হাতের পরশ পাই। সেটি ছিল বাবার শিকল পরা হাতের পরশ! পৃথিবীর সকল সদ্যজাত শিশুই তার বাবার মুক্ত হাতের পরশ পায়। আর আমার মত নুমায়েররা পায় শিকল পরা হাতের পরশ! আমার কপালে বাবা যখন স্পর্শ করেন তখন বাবার দেহটি লোহার শিকলের ভেতরে আর মা আমাকে কোলে করে শিকলের বাইরে দাঁড়িয়ে। শেকলের ভেতর থেকে বাবা যখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন তখন লোহার শেকলের বাইরে দাঁড়িয়ে আমাকে কোলে নিয়ে মা নির্বাক হয়ে বাবার আদর দেখছিলেন। তপ্ত মরুভূমিতে পানির তৃষ্ণায় কাতর একজন পিপাসার্ত মানুষের যে অবস্থা হয়, আমাকে কাছে পাওয়ার জন্য বাবার ছিল ঠিক সেই রকম তীব্র আকাক্সক্ষা। বাবা চাচ্ছিলেন আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে তৃপ্তি দিয়ে বুকের ভেতরে দাউ দাউ করে জ্বলা শূন্যতাকে নেভাতে। কিন্তু লোহার শিকলে বাবার সেই অদম্য ইচ্ছাকে পূর্ণতা দেয়নি। আমরা কত কাছে ছিলাম তবুও লোহার শিকল আমাদের মাঝে যোজন যোজন দূরত্বের ব্যবধান দাঁড় করিয়ে দেয়। আবেগাপ্লুত বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছেন, দেখে রাখ জালিমের জেলখানা, ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধে(!) বড় হয়ে একদিন তোমাকেও এখানে আসতে হতে পারে।

লোহার শেকলে বন্দী বাবার বিনিদ্র রাত কাটে আমার চেহারা অঙ্কন করে। আর বাবার আদরবঞ্চিত আমি ছটফট করে হাত-পা ছুড়তে থাকি নিষপ্রাণ গৃহের বিছানায়। বাবার অনুপস্থিতিতে নিষ্প্রাণ গৃহে আমি যখন কান্না করি আমার বোন নামিরা তখন আমাকে বাবা আসবে আসবে বলে সান্ত্বনা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করবেন। এমন আশায় প্রতীক্ষায় থাকি- নামিরা, আমি ও আমার মা। কিন্তু আমাদের প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হয় না। দিন যায়, রাত আসে, মাস যায় আবার মাস আসে তবু লোহার শিকল ভেঙে বাবা আসেন না। পাশের ফ্ল্যাটে আমার মতো আরেকটি শিশুকে যখন তার বাবা আদর করেন তখন আমার বাবার আদর না পাওয়ার হাহাকার আরো বেড়ে যায়। ফিলিস্তিনের শিশুরা নাকি তাদের বাবার জন্য প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে গুনতে এক সময় নির্বাক হয়ে যায়। আমাদের দেশের অবস্থাও কি এমন? আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশও কি ফিলিস্তিনের গাজার মতো আরেকটি নির্যাতিত উপত্যকা? ফিলিস্তিনের শিশুরা যেমন বাবার আদর থেকে বঞ্চিত আমাদের অবস্থাও কি তেমন?
কেন আমি আমার বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হবো? কী অপরাধ আমার বাবার? আমার বাবা কি চোর, ডাকাত কিংবা খুনি? যদি তাই না হয় তাহলে কেন আমার বাবাকে লোহার শিকলের ভেতর বন্দী করে রাখা হবে? ওহ! আমার বাবার তো একটাই অপরাধ, তিনি আল্লাহর এই জমিনেই তারই বিধান কায়েম করতে চান। সত্য, সুন্দর ও ইনসাফভিত্তিক একটি সমাজ বিনির্মাণের জন্য কাজ করেন আমার বাবা- এটাইতো তার অপরাধ! বাবার প্রতিবাদী কণ্ঠে জালিমের প্রাসাদ কেঁপে ওঠে! বাংলাদেশের হাজারও তরুণের কণ্ঠের ধ্বনি আমার বাবার কণ্ঠে প্রতিধ্বনি তোলে। এটাই কি আমার বাবার অপরাধ? এ জন্যই কি আমার মতো হাজারো শিশুর বাবাকে শিকল পরিয়ে রাখা হয়েছে?
ঈদের দিন মা আমাকে ও বোন নামিরাকে নতুন জামা পরিয়েছেন। আতর মেখে খুশবু ছড়িয়েছেন। কিন্তু বাবার অনুপস্থিতি আমাদের গৃহে আনন্দের বার্তা ছড়ায়নি। কারণ আমাকে কোলে নিয়ে ঈদগাহে তো বাবারই যাওয়ার কথা ছিল। পৃথিবীর সকল বাবা তার সন্তানকে কোলে নিয়ে ঈদগাহে যান। আনন্দ করেন। শুধু আমার মতো নুমায়েরের বাবারা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আচ্ছা বলুনতো বাবা না থাকলে কি ঈদের আনন্দ হয়? শূন্যতা পূরণ হয়? না, হয় না। বাবা বাবাই!
আজ আমি হামাগুড়ি দেয়ার চেষ্টা করছি। আস্তে আস্তে আব্বু আব্বু বলে ডাকার চেষ্টা করছি। আমি যখন মুখ দিয়ে আব্বু ডাকার চেষ্টা করি, আমার মা তখন তৃপ্তির হাসি হাসেন। কিন্তু মায়ের সেই তৃপ্তির হাসি তার চেহারায় আর বেশিক্ষণ থাকে না। মুখটি তখন অশ্রুভেজা মলিন হয়ে যায়। মায়ের চোখ দিয়ে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়তে থাকে পানি। শাড়ির আঁচল দিয়ে মা তখন চোখের কোণ থেকে নেমে আসা অশ্রুকে সংবরণ করার বৃথা চেষ্টা করেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে চুমু খেয়ে আদর করে বাবার শূন্যতা ভোলানোর চেষ্টা করেন। so2
মাঝে মধ্যে নামিরা আপু আদালতের বারান্দায় গিয়ে বাবার কোলে ওঠার চেষ্টা করে। বাবার শিকল পরা হাতের স্নেহ ও ভালোবাসা পায়। কিন্তু আমি খুবই ছোট্ট বিধায় আমাকে সবসময় নিয়ে যাওয়া হয় না। বাসায় এসে নামিরা আপু যখন দোলনায় চড়াতে চড়াতে বাবার শিকল পরা হাতের পরশ আর ¯েœহ পাওয়ার গল্প আমাকে শোনায় তখন আমার ভেতরের হাহাকার আরো করুণভাবে ধ্বনিত হতে থাকে। আমি যদি আজ কথা বলতে পারতাম তাহলে চিৎকার করে বলতাম- বাবা আমি তোমাকে অনেক মিস করছি। প্লিজ বাবা! তুমি আমাকে এসে একটু আদর দিয়ে যাও।

বাবার আদর, স্নেহ আর প্রশান্তির পরশমাখা কোলে চড়ে যেখানে আমার বড় হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আজ আমি আদালতের বারান্দায় বড় হচ্ছি। আমার বাবা নিরপরাধ হয়েও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে করুণভাবে চেয়ে থাকেন। সুযোগ পেলেই শেকল পরা হাতে আমাকে আদর করার চেষ্টা করেন। আমার কাছে শিকল পরা হাতের এই পরশ অনেক মূল্যবান। আমার বিশ্বাস, এই শিকল পরা হাতের পরশেই একদিন বিকল হবে জালিমশাহির সকল শিকল।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *