সাহরু রমাদান সম্ভাবনা অফুরান
সাহরু রমাদান সম্ভাবনা অফুরান। বছর ঘুরে আবার এলো মাহে রমজান। মাহে রমজান মুসলিম জাতির প্রতি মহান আল্লাহর সীমাহীন অনুকম্পা ও অসীম অনুদানের এক অনন্ত নজির। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে পবিত্র মাহে রমজান আমাদের নিকট সমাগত। রাসূলুল্লাহ (সা) এ মাসকে ‘শাহরুন মোবারক’ তথা ‘বরকতময় মাস’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রত্যেক মুসলমান রমজান মাসের আগমনে আনন্দিত হয়। যখন রমজানের আগমন হতো, তখন মহানবী (সা.)ও অনেক আনন্দিত হতেন। রমজানের শুরুতে তিনি বিশেষ খুতবা দিতেন। তিনি বলতেন, ‘তোমাদের কাছে বরকতময় মাস রমজান এসে গেছে। এ মাসে আল্লাহ তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দ্বারগুলো খুলে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। অভিশপ্ত শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। এ মাসে রয়েছে একটি রাত, যা হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে সমূহ কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো। ’ (নাসায়ি)
এ মাসে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতি ও কল্যাণের মূল ভিত্তি-তাকওয়াপূর্ণ জীবন গঠনের অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। সূরা আল বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে সে ধ্বনিই অনুরণিত হয়েছে, যা আন্দোলিত করে আমাদের হৃদয়তন্ত্রীকে। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর সাওম ফরয করা হয়েছে, যেমনি ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার”। সাওম যেমন ক্ষুধায়-কাতর দুঃখী মানুষের প্রতি আমাদের মমত্ববোধ জাগিয়ে তোলে, তেমনই শিক্ষা দেয় ধৈর্য, একনিষ্ঠতা, ত্যাগ, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহানুভূতির। প্রেরণা জোগায় শোষণ, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যমুক্ত একটি আদর্শিক সমাজ গড়ার। আর দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসে সংঘটিত বদর যুদ্ধে কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের ইতিহাস আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে ইসলামবিরোধী সকল শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।
মাহে রমজান ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আত্মগঠনের জন্য এক অনন্য প্রশিক্ষণের মাস। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার আলোকে মাহে রমজানকে ‘কুরআন শিক্ষার মাস’ হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। জ্ঞান অর্জন, আত্মগঠন ও আদর্শিক সমাজ বিনির্মাণের দীপ্ত শপথে উজ্জীবিত হয়ে এ মাসে নিম্নোক্ত কাজগুলো আন্তরিকতার সাথে, একাগ্রতার সাথে পালন করা অত্যান্ত জরুরী।
– পূর্ণ দ্বীনি অনুভূতির সাথে রমজানের সিয়াম পালন করা।
– জামায়াতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা।
– তারাবিহ এর নামাজ ইমামের পিছনে জামায়াতে আদায় করা।
– নফল ইবাদতসমূহ অধিক পরিমাণে আদায় করা বিশেষ করে তাহাজ্জুদেও সালাতে মননিবেশ করা।
– এই মাসে সম্পূর্ণ কুরআন মাজিদ কমপক্ষে একবার অর্থসহ তেলাওয়াত করা।
– নিজে সহীহভাবে কুরআন শেখা এবং অন্তত একজনকে কুরআন শিখানোর ব্যবস্থা করা।
– কমপক্ষে এক খন্ড অর্থসহ কুরআন বিতরণের ব্যবস্থা করা।
রমজান মাস পবিত্র মাস। এমাসে কুরআনকে কুরআনের ভাষায় জানা এবং বুঝার চেষ্টা করা। বিশেষ করে অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ অধ্যয়ন ও মুখস্থ করার চেষ্টা করা প্রয়োজন। সূরা আল বাকারা: ১৫৩-১৫৭, ১৮৩-১৮৬, ২৮৬, সূরা আলে ইমরান: ১৯০-২০০, সূরা আত তাওবা: ২০-২৭, ৩৮-৪২, ১১১, সূরা আল মুমিনুন: ১-১১, সূরা আল হাক্কাহ: ১৯-২৯, সূরা ইয়াসিন, সূরা আর রহমান, সূরা আল হুজুরাত, সূরা আস সফসহ বিষয়ভিত্তিক সূরা ও আয়াতসমূহ। কুরআনের পাশাপাশি নিম্নোক্ত হাদিসসমূহ অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ অধ্যয়ন ও মুখস্থ করার চেষ্টা করা। রোজা সংক্রান্ত—: মুসলিম- ২৩৬৩, ২৫৭০, বুখারী- ১৭৬১, ১৭৬৬, ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ সংক্রান্ত—: বুখারী- ২৬০১, ২৬০৭, তিরমিযী- ১৫৬৮, ১৫৮৬, ১৬০৪, তাকওয়া সংক্রান্ত—: রিয়াদুস সালেহীন- প্রথম খন্ড (হাদিস নং-৪১, ৬৯, ৩৮৬-৩৮৭, সালাত, আল্লাহর রাহে অর্থদান ও পর্দা সংক্রান্ত—) সহ গুরুত্বপূর্ণ হাদিস গ্রন্থসমূহ। আমাদের উচিৎ কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে নিজেকে পরিচালনা করা এবং এ বিষয়ে বিষদ জ্ঞানার্জন করা। হযরত মালেক ইবনে আনাস রা. হতে বর্ণিত- রাসূল (সাঃ) বলেছেন- আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যতদিন তোমরা আকড়ে ধরবে ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব এবং অপরটি আমার সুন্নাহ্। (মিশকাত)
মাহে রমজান সাধারন ছাত্রদের নিকট দাওয়াত দানের এক অফুরন্ত সুযোগ। ১-১০ রমজানের মধ্যে প্রত্যেক জনশক্তি ব্যক্তিগতভাবে কমপক্ষে পাঁচজন ছাত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছিয়ে নতুন করে দুইজনকে সমর্থক বৃদ্ধির চেষ্টা করা। প্রত্যেক মসজিদে নামাজের আগে ও পরে কুরআন-হাদিস ও মাসয়ালা-মাসায়েল থেকে বিভিন্ন অংশ পেশ করার চেষ্টা করুন। সহীহ কুরআন তালিমের ব্যবস্থা করা। যেখানে শিশু কিশোর বৃদ্ধরাও কুরআন শিখতে পারবে। রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদরের মহিমান্বিত রাতের কল্যাণ প্রাপ্তির আশায় সময় সুযোগের আলোকে ইতেকাফ করা এবং সর্বোচ্চ ইবাদত করার চেষ্টা করা। শেষ দশকের বিজোড় রাত্রিতে লাইলাতুল কদর তালাশ করা। রমজান মাসে অনৈতিকতা, নগ্নতা, অশ্লীলতাসহ ইসলাম বিরোধী যাবতীয় কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা। জুলুম নির্যাতনের মোকাবেলায় জাগতিক চেষ্টার পাশাপাশি আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তির উপযুক্ত হিসাবে নিজেকে তৈরি করা। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ওপর জুলুম নির্যাতন এবং গুম-খুন বন্ধে সোচ্চার হওয়া এবং জঙ্গি বাদের নামে ইসলামের অগ্রযাত্রা নস্যাতের চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করা। সামর্থের আলোকে সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের পাশে দাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।
রমজান মাস আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অফুরন্ত সম্ভাবনার মাস। রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তায়ালার কাছে মিশক আম্বরের চেয়েও প্রিয়। আর জান্নাতে রাইয়ান নামে একটি দরজা আছে যা শুধুমাত্র রোজাদারদের জন্য নির্দিষ্ট। এ মাসে শয়তানকে করা হয় শৃঙ্খলিত, জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাসমূহ। এ মাসে একটি নফল ইবাদত অন্য মাসের একটি ফরয সমমর্যাদার, আর একটি ফরয অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ সমমর্যাদার। “একটি রোজার বিনিময়ে রোজাদারের চেহারাকে জাহান্নামের আগুন থেকে সরিয়ে দেয়া হয় সত্তর বছরের দূরত্বে।” (বুখারী ও মুসলিম) কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি কেন রোজার এত মর্যাদা? কেনইবা এ মাস এতো শ্রেষ্ঠ! কারণ একটাই- এ মাসে নাযিল হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন, যা সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী। আর এ কুরআন নাযিল করা হয়েছে মহিমান্বিত রজনি লাইলাতুল ক্বদরের রাত্রিতে। এ কারণে লাইলাতুল কদরের মর্যাদা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
কুরআনের কারনে যে রাতের মর্যাদা হাজার বছরের চাইতেও বেশি আমরা যদি ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সেই কুরআনকে ধারণ করতে পারি, নিশ্চয়ই আমাদের মর্যাদাও বাড়বে বহুগুণ। আজকে সমাজের অশান্তির মুল কারন কুরআন থেকে দুরে সরে যাওয়া। তাই কুরআনের আলোকে সমাজ বিনির্মাণের প্রচেষ্টাই হোক মাহে রমযানের মূল ভিশন। কুরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের কারণে রাসূলুলাহ (স) সহ সাহাবীরা (রা) বন্দী ছিলেন শিয়াবে আবি তালিবে, শহীদ হয়েছিলেন আমীর হামযা, খোবায়েব, খাব্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহুমসহ বিশিষ্ট সব সাহাবীরা। তাদের পথ অনুসরণ করার কারণে আজ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে— নির্বিচারে শহীদ করা হচ্ছে কুরআনপ্রেমী জনতাকে। শুধু তাই নয়, নব্বই ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশে কুরআনের পথে চলার অপরাধে (!) বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয়েছে শত শত প্রতিবাদী নারী, পুরুষের দেহকে। অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হাত পা ভেঙ্গে বিনা চিকিৎসায় কারান্তরীণ করে রাখা হয়েছে অসংখ্য ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীকে। কারান্তরীণ অবস্থায় ইতোমধ্যেই শহীদ করা হয়েছে আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ ইসলামী আন্দোলনের পাঁচ শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে এবং অবশিষ্ট নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আজও চলমান রয়েছে। শহীদের রক্তভেজা এই জমিনে আমরা যারা কুরআনের সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয়ে চলছি, আমাদের অবশ্যই ত্যাগ-কুরবানি ও তাকওয়ার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হয়ে আঞ্জাম দিতে হবে শহীদদের রেখে যাওয়া কঠিন দায়িত্ব। দীপ্ত শপথ নিতে হবে কুরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যথাযথ ভূমিকা পালনের এবং প্রস্তুতি নিতে হবে ইসলামের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে। আর ব্যক্তিগত জীবনে পরিস্ফুটন করতে হবে ধৈর্য, তাকওয়া ও ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত—, তাহলে ষড়যন্ত্রকারীদের সকল চক্রান্ত— নস্যাৎ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। কুরআনের বাণী- “আর যদি তোমরা সবর কর, তাকওয়া অবলম্বন কর তাহলে তাদের কোন চক্রান্ত—ই তোমাদের প্রতি করতে পারবে না।” (সূরা আলে ইমরান: ১২০)
মাহে রমজান আল্লাহর কাছ থেকে বান্দার গুনাহ মাপের জন্য এক চমৎকার সুযোগের মাস। তাইতো বলা হয় ‘সাহরু রমাদান সম্ভাবনা অফুরান’। রাসূল (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি রমজান মাসে ঈমান ও আত্মসমালোচনার সাথে সাওম পালন করবে আল্লাহ তায়ালা তার বিগত দিনের সকল গুনাহ মাফ করে দেবেন।” তিনি আরও বলেছেন, “যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল কিন্তু তার জীবনের গুনাহ মাফ করে নিতে পারল না তার জন্য ধ্বংস।” (বুখারী ও মুসলিম) সুতরাং জীবন বিনির্মাণের সৌভাগ্যের সোপান হিসাবে গ্রহণ করতে হবে মাহে রমজানকে। আসুন আমরা সকলে যথাযথ ভাবে রমজানের সিয়াম পালন, কুরআন হাদিস অধ্যয়ন ও বেশি বেশি নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করি। একই সাথে কুরআনের আলোকে ব্যক্তি ও সমাজ গঠনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ইসলামী সমাজ বিনিমাণের কাজ আরও বেগবান করি। আল্লাহ আমাদের সকল প্রচেষ্টা কবুল করুন। আমিন।